ঢাকা, সোমবার   ২৪ জুন ২০২৪ ||  আষাঢ় ৯ ১৪৩১

সর্বজনীন পেনশন স্কিম ও সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১০:৫৭, ১৩ জুন ২০২৪  

সর্বজনীন পেনশন স্কিম ও সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা

সর্বজনীন পেনশন স্কিম ও সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা

কর্মজীবন শেষে একজন নাগরিককে যেন আর্থিক অনটনের কারণে দুরবস্থার মধ্যে জীবন যাপন করতে না হয়, তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশে প্রথম বারের মতো প্রণীত হয়েছে সর্বজনীন পেনশন স্কিম। ২০১৫ সালে প্রণীত জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলে সামাজিক সুরক্ষার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট বক্তৃতায় সর্বজনীন পেনশন-ব্যবস্থা প্রবর্তনের ইঙ্গিত দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ৩১ জানুয়ারি ২০২৩ ‘সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন’ প্রণয়ন করা হয়। একই বছরের ১৭ আগস্ট মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা অনুষ্ঠানিকভাবে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের উদ্বোধন করেন। এর আগে দীর্ঘদিন এর ওপর কাজ করতে হয়েছে। প্রাপ্তবয়স্ক (১৮ থেকে ৫০ বছর) যেকোনো ব্যক্তি এই সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তিগণ স্কিমে অংশগ্রহণের তারিখ থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে ১০ বছর জমা প্রদান সাপেক্ষে সর্বজনীন পেনশন-সুবিধা ভোগ করতে পারবেন।গড় আয়ু বৃদ্ধি এবং একক পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে মানুষ ক্রমশ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে। তারা শেষ বয়সে অনেকটাই নিরুপায় হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় টেকসই সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। সেই দাবি পূরণের লক্ষ্যেই প্রণীত হয়েছে সর্বজনীন পেনশন স্কিম। একজন মানুষ তার কর্মজীবনে যে অর্থ উপার্জন করেন, তা থেকে কিছু অর্থ এই স্কিমে জমা রাখার মাধ্যমে জীবনের শেষ পর্যায়ে আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবেন। বৃদ্ধ বয়সে দেশের কোনো নাগরিক যাতে অর্থাভাবে অসহায় হয়ে না পড়ে, সরকার সেই ব্যবস্থা করতে চায়।  

বাংলাদেশর আর্থসামাজিক অবস্থায় সর্বজনীন পেনশন স্কিম সম্পূর্ণ নতুন একটি ধারণা। সাধারণ মানুষের মধ্যে এই স্কিম সম্পর্কে এখনো স্বচ্ছ ধারণা সৃষ্টি হয়নি। তাই তাদের এই কল্যাণমূলক স্কিমে অন্তর্ভুক্ত করতে হলে এর ভালোমন্দ নিয়ে আলোচনার অবকাশ রয়েছে। যদিও জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ সারা দেশে এই স্কিম সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে অবহিত এবং এতে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করার জন্য নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সর্বজনীন পেনশন স্কিম নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পরিলক্ষিত হচ্ছে। সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালায় প্রাথমিকভাবে চারটি স্কিমের কথা বলা হয়। এগুলো হচ্ছে ‘প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা’। পরবর্তী সময়ে বিধিমালা সংশোধন করে স্বশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ‘প্রত্যয়’ নামে আরো একটি স্কিমের প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী ১ জুলাই, ২০২৪ তারিখ বা তার পরে এসব প্রতিষ্ঠানে যোগদান করবেন, তারা এই স্কিমের আওতায় আসবেন। যারা এই তারিখের আগে এসব প্রতিষ্ঠানে যোগদান করেছেন, তারা প্রচলিত নিয়মে যথারীতি পেনশন ভোগ করবেন। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাকরি ১০ বছর বা তারও বেশি অবশিষ্ট আছে, তারাও চাইলে এই পেনশন স্কিমে যোগদান করতে পারবেন। 

যারা প্রত্যয় স্কিমে অর্ন্ভুক্ত হবেন, তারা নিজেদের মূল বেতনের ১০ শতাংশ জমা দেবেন। আর প্রতিষ্ঠান দেবে ১০ শতাংশ। কিন্তু সর্বোচ্চ লিমিট আছে ৫ হাজার টাকা। অর্থাত্, ব্যক্তি ৫ হাজার টাকার বেশি এই খাতে জমা দিতে পারবেন না। প্রতিষ্ঠানও ৫ হাজার টাকা জমা দেবে। পারসেন্টেজ হিসাবের ক্ষেত্রে পরবর্তী রাউন্ড ফিগারকে বিবেচনায় নেওয়া হবে। প্রতিটি স্কিমের জন্য নির্ধারিত হারে জমা প্রদানের বিধান রয়েছে। যারা সমতা স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হবেন, তারা মাসিক ৫০০ টাকা করে জমা দেবেন। আর সরকার দেবে ৫০০ টাকা। সুরক্ষা স্কিমের জন্য মাসিক জমার পরিমাণ হবে সর্বনিম্ন ১ হাজার টাকা এবং সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা। প্রগতি স্কিমের জন্য মাসিক জমার পরিমাণ হবে সর্বনিম্ন ২ হাজার টাকা এবং সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা। প্রবাস স্কিমের জন্য মাসিক জমার পরিমাণ হবে সর্বনিম্ন ২ হাজার টাকা এবং সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা।

আগেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের মতো জনকল্যাণমূলক আর্থিক কার্যক্রম সম্পূর্ণই নতুন একটি ধারণা। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ তো বটেই, শিক্ষিত-সচেতন ব্যক্তিরাও ১৭ আগস্ট, ২০২৩ তারিখের আগে এমন একটি স্কিমের কথা জানত না। এটা অস্বীকার করার কিছু নেই যে, সাধারণ মানুষ এখনো এই পেনশন স্কিম সম্পর্কে খুব একটা সচেতন নন। তবে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ মাঠ প্রশাসনের সহায়তায় সর্বস্তরের মানুষকে সর্বজনীন পেনশন স্কিম সম্পর্কে জ্ঞাত করানোর জন্য নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে উদ্বুদ্ধমূলক ও অবহিতকরণ কার্যক্রম পরািলনা করা হচ্ছে। এসব কর্মসূচিতে সর্বস্তারের মানুষের ব্যাপক উপস্থিতি ও আগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছে। আমরা বিশ্বাস করি, প্রচারেই প্রসার। যদি মানুষকে ভালোভাবে এই স্কিম সম্পর্কে অবহিত করা যায়, তাহলে তারা এতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য আগ্রহী হবেন। সর্বজনীন পেনশন স্কিমের কার্যক্রম শুরু হয়েছে খুব বেশি দিন হয়নি। দেশের ১৭ কোটি মানুষের কাছে এই স্কিমের বার্তা পৌঁছে দিতে কিছুটা সময় তো লাগবেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মহোদয়ের নেতৃত্বে ইতিমধ্যে জাতীয় পর্যায়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিনি বিভাগীয় পর্যায়ে আয়োজিত পেনশন মেলা ও কর্মশালায় যোগ দিচ্ছেন। বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে বিভাগীয় পর্যায়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নেতৃত্বে অনুরূপ কমিটি গঠিত হয়েছে। এই কমিটিগুলো জাতীয় পেনশন স্কিম সম্পর্কে সর্বস্তরের মানুষকে অবহিত ও উদ্বুদ্ধকরণের লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে। সরকার সর্বজনীন পেনশন স্কিম কার্যক্রমকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। ইতিমধ্যে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। অবশিষ্ট বিভাগীয় শহরেও কিছুদিনের মধ্যে মেলা অনুষ্ঠিত হবে। জেলা পর্যায়েও অনুরূপ মেলার আয়োজন করা হবে।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিস্ময়কর উন্নতি সাধন করে চলেছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। জাতিসঙ্ঘের রেটিংয়ে বাাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের প্রাথমিক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ২০২৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উন্নীত হবে। এই উন্নয়ন অগ্রযাত্রা নিশ্চিত এবং আরো বেগবান করার জন্য মানবসম্পদের উন্নয়ন ও সর্বোত্তম ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। অনেকেই কর্মজীবন শেষে নানা কারণেই আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে পড়েন। তারা সেই অবস্থায় আর্থিক সমর্থন বা সহযোগিতা পান না। দেশের বেশির ভাগ চাকরি পেনশনযোগ্য নয়। এছাড়া ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে পেনশন-ব্যবস্থা চালু নেই। দেশের মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত বা যুক্ত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছেন। অবসরজীবনে তারা চাইলেও কোনো মহল থেকে আর্থিক সহায়তা পান না। কিন্তু সর্বজনীন পেনশন স্কিম এসব মানুষের জন্য আশার আলো নিয়ে এসেছে। সর্বজনীন পেনশন স্কিমে যুক্ত হলে তারা অবসরজীবনে আর্থিক নিরাপত্তা খুঁজে পাবেন।

যে পেনশন স্কিম নিয়ে আমরা কাজ করছি, এটি ডিফাইন কন্ট্রিবিউটারি সিস্টেম এবং এটি ফান্ডেড স্কিম। ডিফাইন কন্ট্রিবিউটরি সিস্টেম বিশ্বের প্রায় সব দেশেই আছে। এ ধরনের স্কিমে কিছু চ্যালেঞ্জ থাকলেও দারিদ্র্যবিমোচন তথা একজন নাগরিকের জন্য পরিণত বয়সে আর্থিক সুরক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে এই স্কিম অত্যন্ত কার্যকর। সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অংশগ্রহণকারী জমাকারীগণ নিরবিচ্ছিন্নভাবে জমা প্রদানের শর্তে ৬০ বছর পূর্তিতে আজীবন মাসিক পেনশন প্রাপ্য হবেন। পেনশন স্কিমে অংশগ্রহণকারী এক বা একাধিক নমিনি মনোনীয় করতে পারবেন। তবে জমাকারী নির্ধারিত বয়স পূর্তির আগেই মৃত্যুবরণ করলে নমিনি বা নমিনিগণ জমাকৃত সমস্ত অর্থ মুনাফাসহ ফেরত পাবেন। জমাকারী আজীবন পেনশন প্রাপ্য হবেন। পেনশনে থাকাকালে ৭৫ বছর বয়স হওয়ার আগে মৃত্যুবরণ করলে নমিনি বা উত্তরাধিকারীগণ অবশিষ্ট সময়ের জন্য (৭৫ বছর পর্যন্ত) উক্ত পেনশন প্রাপ্য হবেন। ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সি ব্যক্তিদের ৬০ বছর পর্যন্ত জমা প্রদান করতে হবে। তারপর তারা পেনশন প্রাপ্ত হবেন। আর যার বয়স ৫০ বছরের বেশি, তিনিও এই স্কিমে অংশগ্রহণ করতে পারবেন এবং ১০ বছর নিরবচ্ছিন্ন জমা প্রদানের পর পেনশন প্রাপ্য হবেন।

এটি রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টিযুক্ত স্কিম। জাতীয় পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন, ২০২৩ অনুযায়ী জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের যাবতীয় ব্যয় সরকার কর্তৃক বরাদ্দকৃত বাজেট থেকে নির্বাহ করা হবে। পেনশন তহবিল আলাদা থাকবে এবং এই তহবিলের টাকা শুধু বিনিয়োগ এবং অ্যানুইটি প্রদানে ব্যয় করা যাবে। কম ঝুঁকিপূর্ণ এবং অধিক লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করা হবে। বিনিয়োগ বিধিমালা প্রণয়নের কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এই খাতে জমাকৃত অর্থ ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করা হয়েছে, যা ঝুঁকিবিহীন এবং মুনাফা বেশি।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়