ঢাকা, শুক্রবার   ২৮ জুন ২০২৪ ||  আষাঢ় ১৫ ১৪৩১

রদবদল নিয়ে বিএনপিতে বিভক্তির শঙ্কা

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৩:৪৪, ২২ জুন ২০২৪  

রদবদল নিয়ে বিএনপিতে বিভক্তির শঙ্কা

রদবদল নিয়ে বিএনপিতে বিভক্তির শঙ্কা

বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদে রদবদলে দলের ভেতর অসন্তোষ এবং ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। একক সিদ্ধান্তে এমন রদবদল নিয়ে দলে নানা প্রশ্ন উঠেছে।

দলের নেতাকর্মীদের ধারণা, পরবর্তী রদবদল প্রক্রিয়া স্বচ্ছ না হলে নেতাদের ক্ষোভ প্রকাশ্যে আসতে পারে। দলে বিভক্তি তৈরির শঙ্কাও রয়েছে।   বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের নেতারা মনে করেন, মূলত তিন কারণে দলের ভেতরে দ্বন্দ্ব-কোন্দল প্রকাশ্যে আসতে পারে। প্রথমত, এই রদবদলের বিষয়ে দলের মহাসচিবসহ জ্যেষ্ঠ নেতারা কেউ জানতেন না। দ্বিতীয়ত, রদবদলে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের অপছন্দের নেতাদের অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। আবার তাঁর পছন্দের নেতারা ‘খুব বেশি’ অতিমূল্যায়িত হয়েছেন।  তৃতীয়ত, দলীয় কাউন্সিল ছাড়া প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে কমিটি গঠনের নজির নিকট অতীতে নেই। কাউন্সিল ছাড়া এভাবে কমিটি গঠন প্রক্রিয়াকে ইতিবাচকভাবে নেননি বেশির ভাগ নেতাকর্মী।

দলের নেতাদের আলোচনা থেকে জানা যায়, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও কয়েকটি পদের রদবদলে মনঃক্ষুণ্ন হয়েছেন। তিনি বিষয়টি নিয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে কথাও বলেছেন।  ফলে কমিটির অন্য পদে রদবদলের বিষয়টি তাঁকে আরো ভেবেচিন্তে করতে হচ্ছে।

দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারেক রহমান গঠনতন্ত্র মোতাবেক একক ক্ষমতাবলে নেতৃত্বে পরিবর্তন আনতে শুরু করেছেন। কিন্তু জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই এভাবে কমিটি গঠনের বিষয়টি দলের শীর্ষ পর্যায়ে ক্ষোভ তৈরি করেছে।

জ্যেষ্ঠ নেতাদের মধ্যে তারেক রহমানের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হলেও এখনো প্রকাশ্যে কেউ প্রশ্ন তোলেননি। তবে কমিটির পরবর্তী পদে রদবদলেও একই চিত্র দেখা গেলে ক্ষোভ-বিক্ষোভ কিংবা অসন্তোষের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসতে পারে।  

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একজন জ্যেষ্ঠ নেতা গত দুই জাতীয় কাউন্সিলের কথা উল্লেখ করে বলেন, সেই সময় খালেদা জিয়া বড় পরিসরে জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি পুনর্গঠন করেছিলেন। কাউন্সিলররা তাঁকে কণ্ঠভোটে কমিটি গঠনের ক্ষমতা দিয়েছিলেন। তার পরও দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন আলোচনার ভিত্তিতে তিনি কমিট গঠন করেন। অর্থাৎ কাউন্সিলের পর তিনি কমিটি গঠনে দলের ভেতর গণতন্ত্র চর্চার বিষয়টি প্রাধান্য দিয়েছিলেন। কিন্তু এবার সে রকম হয়নি।

অবশ্য বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় দৃঢ়তার সঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেন, কমিটি গঠনের বিষয়ে স্থায়ী কমিটিতে নানা সময় আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেই সিদ্ধান্ত এখন বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, কমিটি গঠনের পর সবার প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তি না-ও মিলতে পারে।

গত কয়েক দিনে বিএনপির অন্তত এক ডজন নেতার সঙ্গে কথা বলে কমিটি গঠন প্রক্রিয়া এবং কিছু নেতার পদায়নে অসন্তুষ্টির কথা জানা গেছে। জ্যেষ্ঠ নেতারা মনে করছেন, কাউন্সিল বা কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক আলোচনা ছাড়াই এভাবে কমিটি গঠন দলের স্বাভাবিক ছন্দ নষ্ট হয়েছে।

স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দল পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে নেতারা মতামত দিলেও শীর্ষ নেতা কখনো আলোচনা বাড়াননি। বরং তিনি বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন।   

দুই সপ্তাহ আগে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ গুরুত্বপূর্ণ দুজন নেতা দলের কাউন্সিল করার প্রস্তাব তোলেন। তখনো তারেক রহমান এই প্রক্রিয়া কমিটি গঠনের কথা নেতাদের জানাননি। কাউন্সিলের বিষয়ে আলোচনাও বাড়াননি।

সরকারবিরোধী আন্দোলনে ব্যর্থতার দায়ে ১৩ জুন মধ্যরাতে ঢাকা মহানগর উত্তর, দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও বরিশাল মহানগর বিএনপি কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। একই সময় ছাত্রদলের ঢাকার চার মহানগর কমিটি এবং যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটিও বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। এরই মধ্যে গত শনিবার কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের ২৬০ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে।

এর এক দিন পরেই বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদ ও জাতীয় নির্বাহী কমিটির ৪৫ পদে রদবদল করা হয়। দলের ভেতরে ক্ষোভটা প্রকৃতপক্ষে তখনই শুরু হয়েছে। কমিটি গঠনের বিষয়টি গণমাধ্যমে আসার পর জ্যেষ্ঠ নেতাদের নজরে আসে।   

দলে কেন একচ্ছত্র বলয় চান তারেক রহমান

তারেক রহমান স্পষ্টত জানেন, জোট সরকারের সময় থেকে দলের নীতিনির্ধারক ও গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের অনেকের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব রয়েছে। ওই নেতারা দল ভাঙতে পারেন কিংবা তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ তৈরি করতে পারেন—এমন আশঙ্কা তিনি সব সময় করেন। তা ছাড়া দলে খালেদা জিয়ার অনুগতদের তিনি কখনোই বিশ্বাসে আনতে পারেননি।

মূলত এই শঙ্কা ও অবিশ্বাস থেকে তিনি মনে করেন, নেতাদের একাংশ যেকোনো সময় তাঁর নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে। তাঁর নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। কাউন্সিল করা হলে তাঁকে চেয়ারম্যান পদ থেকে বাদ দেওয়ার ষড়যন্ত্রও হতে পারে। সে জন্য তিনি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এমন কমিটি করতে চান, যাতে তাঁর বলয়ের নেতারা গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকেন।

বিএনপির শীর্ষ এক নেতা মনে করেন, তারেক রহমানের পছন্দের নেতারা গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকলে তাঁর কোনো সিদ্ধান্তের প্রতি আঙুল তুলতে পারবেন না। ফলে একচ্ছত্রভাবে দল চালাতে পারবেন তিনি।   

তারেক রহমানের এই পরিকল্পনার বিষয়ে জানেন—এমন একজন নেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, তিনি একটি তারুণ্যনির্ভর দল গঠন করতে চান। জ্যেষ্ঠ নেতাদের যাঁদের না রাখলেই নয়, তাঁদের কমিটিতে রাখবেন। তারুণ্যনির্ভর দল গড়ার পেছনে তাঁর মূল উদ্দেশ্য, দলের সঙ্গে অতীতে যাঁরা বেঈমানি করেছেন, তাঁর সঙ্গে যাঁদের দূরত্ব আছে কিংবা যাঁরা তাঁর সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন—এমন নেতাদের বাদ দেওয়া কিংবা উপদেষ্টা নিয়োগ করে কোণঠাসা করে রাখা।

দলের একটি সূত্র জানিয়েছে, তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠরা তাঁকে পরামর্শ দিয়েছেন, কেন্দ্রীয় কমিটি পুনর্গঠন হওয়ার পর কাউন্সিলের আয়োজন করতে। কারণ নিজ বলয়ের লোকদের দিয়ে কমিটি গঠন করা হলে কাউন্সিলে তাঁর নেতৃত্বকে কেউ চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ পাবে না এবং কমিটি গঠনের বিষয়টি কাউন্সিলের অনুমোদন নিয়ে নেবেন।

খালেদা জিয়া ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দণ্ড নিয়ে কারাগারে যান। এরপর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হন তারেক রহমান। তখন থেকে তারেক রহমান দলের নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করেন। লন্ডন থেকেই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। দলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর প্রথমে বলা হতো তারেক রহমান ও স্থায়ী কমিটির যৌথ নেতৃত্বে বিএনপি চলছে। এখন আর সেই যৌথ নেতৃত্বের কথাও বলা হয় না। 

সমালোচনার মুখে কী করবেন

বিএনপির একজন নীতিনির্ধারক জানান, অনেক নেতার মৃত্যু ও দলত্যাগের পরও বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির পদসংখ্যা এখনো পাঁচ শতাধিক। এবার কমিটির আকার ছোট হতে পারে। তার পরও পুনর্গঠনের প্রথম ধাপের পর দলের নেতাদের মধ্যে যে সমালোচনা তৈরি করেছে, এতে তারেক রহমান কি একক সিদ্ধান্তে এগোবেন, না জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন, তা এখনো স্পষ্ট নয়।

তবে অতীতে তারেক রহমানের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতা দেখে ধারণা করা হচ্ছে, কৌশলগত কারণে তিনি কয়েক দিন চুপ আছেন। কিন্তু কমিটি নিজের মতোই করবেন। এ নিয়ে জ্যেষ্ঠ নেতারা কে কী বলেন, তা তিনি তোয়াক্কা করবেন না।

২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের মনোনয়ন দেওয়ার সময় পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠকের সিদ্ধান্তের পরও প্রায় ৩০ থেকে ৪০ আসনে পরিবর্তন করেছিলেন তিনি। ওই আসনগুলোতে নিজের বলয়ের লোকদের মনোনয়ন দিয়েছিলেন। গত বছরের জুন থেকে ৭ জানুয়ারির নির্বাচন পর্যন্ত আন্দোলন কর্মসূচির বেশির ভাগই তিনি একক সিদ্ধান্তে নিয়েছিলেন, যা দলের নেতাদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করেছিল।

দলে রদবদলের বিজ্ঞপ্তিতে স্বাক্ষর করেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুল কবীর রিজভী। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, গঠনতন্ত্রের কোনো ব্যত্যয় না ঘটিয়ে রদবদল করা হয়েছে। দলের কাউন্সিলররা পরবর্তী কাউন্সিল পর্যন্ত যেকোনো পদায়নের ক্ষমতা শীর্ষ নেতাকে দিয়েছেন।   

মহানগর বিএনপি ও যুবদল নিয়ে নানা আলোচনা

কমিটি বিলুপ্ত করার এক সপ্তাহ পরও ঘোষণা করা হয়নি ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ ও যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটি। ফলে কমিটি গঠন এবং কারা নেতৃত্ব আসছেন, তা নিয়ে নানা গুঞ্জন তৈরি হয়েছে। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে যাঁদের নাম শোনা যাচ্ছে, তাঁদের বিরোধিতাও করছেন অনেকে। সম্ভাব্য পদপ্রত্যাশীদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে তারেক রহমানের কাছে অভিযোগও গেছে। 

রাজনীতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
সর্বশেষ
জনপ্রিয়