ঢাকা, বুধবার   ০৩ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ১৮ ১৪৩১

ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে বেড়েছে শীতল পাটির চাহিদা, ব্যস্ত সময় পাড় করছেন কারিগররা

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১১:১২, ১ জুলাই ২০২৪  

ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে বেড়েছে শীতল পাটির চাহিদা, ব্যস্ত সময় পাড় করছেন কারিগররা

ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে বেড়েছে শীতল পাটির চাহিদা, ব্যস্ত সময় পাড় করছেন কারিগররা

ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী হালুয়াঘাট উপজেলার বিলডোরা ইউনিয়ন। নিন্মাঞ্চল হওয়ায় বর্ষায় এলাকাটির অধিকাংশ ফসলি জমি থাকে পানির নিচে। দরিদ্র এই এলাকার বেশীরভাগ মানুষের প্রধান পেশাই হচ্ছে কৃষি। বর্ষায় মাছ ধরে অনেকে পরিবারই জীবন ধারণ করে থাকেন। এই ইউনিয়নের দাসপাড়া গ্রামের বেশীরভাগ পরিবার স্বাধীনতার আগে থেকেই ঐতিহ্যগত ভাবে শীতলপাটি কুটির শিল্পের সাথে জড়িত। পাশাপাশি এই উপজেলার স্বদেশী ইউনিয়নের পিকা বন্যাপাড়া এলাকার কিছু পরিবারও এ শিল্পের সাথে জড়িত।

শীতলপাটি গ্রাম-বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য। গ্রাম কিংবা শহরের সৌখিন মানুষদের কাছে শীতলপাটির কদর অনেক। এক সময় গ্রামের বাড়িতে অতিথিদের বসার জন্য দেওয়া হতো শীতলপাটি। বর্তমানে শীতলপাটি বিয়ে, সুন্নতে খাৎনাসহ বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হয়। স্থানীয় কারিগরদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্লাস্টিকের রেক্সিন ও পাটির কারণে বছর খানের আগে এর চাহিদা হ্রাস পেলেও গেলো বছর থেকে আবারো শীতলপাটির চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। গরমের কারণে অগ্রিম অর্ডার দিয়েও চাহিদা পূরণ করা যাচ্ছেনা বলে জানান এর সাথে জড়িত কারিগররা। শীতলপাটি বুননের প্রধান কাঁচামাল হচ্ছে মুরতা বেত। বাড়ির কর্তাব্যাক্তিরা হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া উপজেলার বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মুরতা গাছের ঝোপ ক্রয় করে নিয়ে আসেন। শুষ্ক মৌসুমে গাছ পরিপক্ব হলে কেটে বেত করা হয়। প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি হওয়ার কারণে এই পাটি একেবারেই স্বাস্থ্যসম্মত বলে জানান কারিগররা।

দাসপাড়া গ্রামের শীতলপাটি তৈরির কারিগর ইতি রানী সরকার বলেন, আমার বিয়ে হয়েছে প্রায় ১৫ বছর। আমি আগে শীতলপাটি কিভাবে তৈরি করতে হয় জানতাম না। আমার শ্বাশুড়ির কাছ থেকেই প্রথম আমার হাতেখড়ি। আমরা প্রথমে বেতগুলো ভালোভাবে পানিতে সেদ্ধ করে নিই। পাটিতে নকশা ফুটিয়ে তুলতে সেদ্ধ বেতগাছগুলো আবার রোধে শুকিয়ে বাজার থেকে নিয়ে আসা রং মিশিয়ে আবারো সেদ্ধ করি, যাতে করে রং উঠে না যায়। এভাবে মাপ ও নকশাভেদে একেকটি বড় মাপের পাটি তৈরিতে ১৫ থেকে ২০ দিন লাগে। আগে পাটির চাহিদা কম ছিল, তাই বাড়ির কাজের ফাঁকে ফাঁকে করতাম। এখন চাহিদা বেশী হওয়াতে দীর্ঘসময় নিয়ে করতে হচ্ছে। এই প্রক্রিয়াটি অনেক সময় ও শ্রম সাপেক্ষ। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে কাজ থাকেনা বললেই চলে। ফলে আমরা বেশীরভাগ সময় শীতলপাটি তৈরিতেই বেশী ব্যস্ত থাকি।

দাসপাড়া গ্রামের আরেক কারিগর চঞ্চলা রানী সরকার বলেন, গেল বছর থেকেই শীতলপাটির চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা করোনার সময়ে এক রকম শীতলপাটি তৈরির কাজ বন্ধই করে দিয়েছিলাম। বাজারে প্লাষ্টিক পাটির কারণে বেশীদাম দিয়ে কেউ শীতলপাটি নিতে চাইতো না। কিন্তু হঠাৎ করে গেলো বছর গরম আবহাওয়ার কারণে শীতলপাটির চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষ বুঝে প্লাষ্টিকের পাটিতে বসে কিংবা শুয়ে থাকলে গরমের মাত্রা বেড়ে যায়। কিন্তু শীতলপাটি ঠিক এর উল্টো। গরমে এতে ঠান্ডা অনুভূত হয়। নামাজের পাটি, সাধারণ পাটি, পিট্ট বেতির পাটি ও বোক্কার বেতির পাটি তৈরি করেন। ছোট পাটি বানাতে ৬ থেকে ৭ দিন সময় লাগে। বিছানায় ব্যবহারের বড় মাপের পাটি ১৫০০ থেকে ২২০০ টাকা করে বিক্রি করছি। বড় পাটি তৈরি করতে ১৫ থেকে ২০ দিন সময় লেগে যায়। এতে আমাদের সংসারের আয় অনেকাংশেই বৃদ্ধি পেয়েছে।

চঞ্চলা রানীর স্বামী কমল চন্দ্র সরকার বলেন, আমাদের এখানে প্রায় ৪০টি পরিবার রয়েছে। পরিবারের নারী সদস্যরা সবাই এ শিল্পের সাথে জড়িত। আমার দাদী, আমার মা ও আমার স্ত্রী সকলেই এই শিল্পের সাথে জড়িত। এটি আমাদের বংশগত পেশা। তবে মাঝে কিছুদিন এর চাহিদা কম থাকলেও আবারো ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভিন্ন এলাকার পাইকার ও সাধারণ মানুষ প্রতিদিনই আমাদের গ্রামে শীতলপাটি নেওয়ার জন্য আসছেন। চাহিদামত আমরা দিতে পারছিনা। এর প্রধান কারণ হচ্ছে হাতে তৈরি করার কারণে সময় লাগছে বেশী। আগে তো মুরতা গাছের বেত আমাদের এলাকাতেই পাওয়া যেত। কিন্তু বর্তমানে এ সকল জমি ফসলের আওতায় নিয়ে আসার কারণে বিভিন্ন উপজেলায় খুঁজে খুঁজে বেত গাছ ক্রয় করে নিয়ে আসতে হচ্ছে। ফলে আমাদের খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দাম বেশী হওয়া সত্যেও মানুষের চাহিদাও কমছেনা। যদি এভাবে চলতে থাকে তাহলে বাপ-দাদার এই ঐতিহ্যবাহী পেশাটি দীর্ঘকাল টিকে থাকবে বলে মনে করি।

শীতলপাটির পাইকার বাদন বসাক বলেন, আমি এখান থেকে শীতলপাটি ক্রয় করে ঢাকার একটি দোকানে বিক্রি করি। সেখান থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় চলে যাচ্ছে এই শীতলপাটি। আগে একটি শীতলপাটি ৩ থেকে ৪শত টাকা করে ক্রয় করতাম। এখন সেটা হাজার টাকা ছাড়িয়েছে। মাঝে এর চাহিদা কম থাকলেও গরমের কারণে এর চাহিদা বেড়ে গেছে। ফলে চাহিদা মতো সরবরাহ করতে পারছিনা।

হালুয়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আবিদুর রহমান বলেন, শীতলপাটি আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য। শীতলপাটি শিল্পের সাথে যারা জড়িত, আমরা তাদের উৎসাহিত করতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আর্থিক অনুদানের ব্যবস্থা করে দেব।

সারাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
সর্বশেষ
জনপ্রিয়