ঢাকা, রোববার   ০৭ জুলাই ২০২৪ ||  আষাঢ় ২৩ ১৪৩১

ট্রানজিট নিয়ে সংসদে শেখ হাসিনা

বিশ্বায়নের যুগে দরজা বন্ধ রাখতে পারি না

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ২১:০৩, ৪ জুলাই ২০২৪  

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা ভারতের সঙ্গে ট্রানজিটের সুবিধার কথা তুলে ধরে বলেছেন, বিশ্বায়নের যুগে আমরা নিজেদের দরজা বন্ধ করে রাখতে পারি না। আজ পৃথিবীটা গ্লোবাল ভিলেজ, একে অপরের ওপর নির্ভরশীল, ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ, দরজা বন্ধ করে থাকা যায় না। সারা বিশ্বের সঙ্গে একটা যোগাযোগ হচ্ছে। আমরা নেপাল-ভুটানের সঙ্গে ট্রানজিট করেছি ভারতে। এটা তো কোনো একটা দেশের জন্য নয়, আঞ্চলিক ট্রানজিট সুবিধা এবং যোগাযোগ সুবিধার জন্য করা হয়েছে।

তিনি বলেন, আমাদের ট্রান্স-এশিয়া হাইওয়ে, ট্রান্স-এশিয়া রেলের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। আজ ভারতকে আমরা ট্রানজিট দিলাম কেন, এ নিয়ে নানা প্রশ্ন! আমাদের ট্রানজিট তো আছেই। ত্রিপুরা থেকে বাস চলে আসে ঢাকায়, ঢাকা হয়ে কলকাতা পর্যন্ত তো যাচ্ছে। এতে ক্ষতিটা কী হচ্ছে। বরং আমরা ভাড়া পাচ্ছি। সুবিধা পাচ্ছে আমাদের দেশের মানুষ। অনেকে অর্থ উপার্জনও করছে।

বুধবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদের ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। এ সময় তিনি বলেন, আজ আমরা নেপাল, ভুটান, ভারত ও বাংলাদেশ-এ চার দেশ প্রতিটি দেশের সঙ্গে যোগাযোগ ও ট্রানজিটের ব্যবস্থা করছি। আজ নেপাল থেকে আমরা জলবিদ্যুৎ কেনা শুরু করতে যাচ্ছি, সেখানে সঞ্চালন লাইন করতে চুক্তি করেছি, তা আমরা কার্যকরও করছি। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর থেকে যেসব রেলপথ, নৌপথে যোগাযোগ বন্ধ ছিল, সেগুলো আমরা উন্মুক্ত করে দিচ্ছি। 

শেখ হাসিনা বলেন, ভুটান থেকে একটি রাস্তা যাচ্ছে মিয়ানমার হয়ে থাইল্যান্ড পর্যন্ত, অথচ সেই রাস্তাটা যাচ্ছে বাংলাদেশকে বাইপাস করে। তাই বাংলাদেশ কেন বিচ্ছিন্ন থাকবে। ভারত চাচ্ছিল ভুটান থেকে রাস্তাটা বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার হয়ে থাইল্যান্ড যাবে। আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ সবকিছুতে সুবিধা হতো, সেটিও খালেদা জিয়া নাকচ করে দিয়েছিলেন। এই হলো অবস্থা। প্রথমবার সরকারে এসে অনেক চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু আমরা যুক্ত হতে পারিনি।

ভারত থেকে পাইপলাইনে তেল নিয়ে আসার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা আসামের রুমালিগড় থেকে পাইপলাইনে তেল নিয়ে এসেছি। পার্বতীপুর ডিপোতে সেই তেল আসছে। ক্ষতিটা কী হয়েছে? বরং আমরা আমাদের দেশের জন্য সস্তায় তেল কিনতে পারছি। ওই অঞ্চলের মানুষের চাহিদা আমরা পূরণ করতে পারছি। উত্তরাঞ্চলে কোনো শিল্পায়ন হয়নি, এখন শিল্পায়নে আমরা যেতে পারি এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রও আমরা নির্মাণ করেছি। আমরা নিজেদের দরজা তো বন্ধ করে রাখতে পারি না। এটিই তো কথা।

খালেদা জিয়া মিয়ানমার থেকে গ্যাস আনার সুযোগ নষ্ট করেছেন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কী সমস্যা দেশের জন্য করেছে দেখেন-মিয়ানমারে সেখানে গ্যাসফিল্ডের গ্যাস ভারত, চীন, জাপান সবাই চাচ্ছে। এ গ্যাসকে বাংলাদেশের ভেতর থেকে ভারতে নিয়ে যাবে, এই নিয়ে যাওয়ার সময় এই গ্যাস থেকে আমরা একটা ভাগ নেব। তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামসহ ওই এলাকায় আমাদের গ্যাসের কোনো অভাবই হতো না। অথচ খালেদা জিয়া সেটা নিতে দেয়নি। তিনি বলেন, আজকে সেই গ্যাস নিচ্ছে চীন। আর কোনো দেশ তো নিতে পারছে না। আমরা সরকারে আসার পর গ্যাস আনতে কথা বলেছিলাম মিয়ানমারের সঙ্গে, আনতে পারি কি না। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। কারণ তারা ইতোমধ্যে দিয়ে দিয়েছে।

ভারত সফর নিয়ে বিভিন্ন মহলের সমালোচনা প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, আমি দেখেতি পাচ্ছি কিছু লোক আমার ভারত সফর নিয়ে নানারকম কথা তুলেছে। ১৯৮১ সালে ছয় বছর পর দেশে ফিরে এই একই কথা শুনতে হয়েছে (ভারতের কাছে দেশ বিক্রি)। এখন জানি না কেন সেই ভাঙা রেকর্ড বাজাতে শুরু করল।
২০০১ সালে ক্ষমতায় আসতে না পারার কারণ ?উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা গ্যাস বিক্রি করতে চাইনি বলে ভোট বেশি পেলেও সে সময় সিট বেশি পাইনি। এজন্য সেবার সরকার গঠন করতে পারিনি। কারণ আমি গ্যাস বিক্রি করতে চাইনি। প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন রেখে বলেন, দেশকে বিক্রিটা করে কে? করে গেছে তো খালেদা জিয়া, করেছে এরশাদ সাহেব। করেছে জিয়াউর রহমান। এরাই করে গেছে, আওয়ামী লীগ করে না।

দেশ বিক্রি কারা করে সেটা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের বাজারটাকে ভারতীয় পণ্যের বাজারের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিল জিয়াউর রহমান ৪০টি পণ্য শুল্কমুক্ত প্রবেশ অধিকার দিয়ে। ১৯৮০ সালে গ্যাস বিক্রির চুক্তিও করে আসে। তিনি বলেন, ১৯৯২ সালে ভারত গেল খালেদা জিয়া। সেখানে যৌথ ইশতেহার ঘোষণার ১১ অনুচ্ছেদে বাংলাদেশ থেকে ব্যাপক হারে ভারতে অনুপ্রবেশ করার কথা স্বীকার করে নেয়। তারপর পুশইন শুরু হয়েছিল। সেখানে আমাদের বহু মানুষ কষ্ট পেয়েছিল। এ অনুচ্ছেদ প্রত্যাহারের জন্য আমরা সংসদে দাবিও করেছিলাম, কিন্তু কর্ণপাত করা হয়নি। এ সময় সরকারপ্রধান বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া, জাতীয় পার্টির হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সময়কার ভারত সফরে দেশের জন্য কোনো কিছুই আনতে পারেনি বলে অভিযোগ করেন তিনি। একই সঙ্গে দলগুলোর কূটনৈতিক ব্যর্থতার কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।

আওয়ামী লীগ সরকার আসার পর ভারত-বাংলাদেশের ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানি চুক্তি, ছিটমহল বিনিময়, তিনবিঘা করিডর উন্মুক্তসহ আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন অর্জনের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, খালেদা জিয়া, জেনারেল এরশাদ ও জিয়াউর রহমান কেউ তো এ সমাধানটা করতে পারেনি।

জেনারেল এরশাদও ভারতে গিয়েছিল। কী এনেছিল বাংলাদেশের জন্য? কিছুই না। পারলে সব দিয়ে আসে। তিনি বলেন, গণতন্ত্রের কথা বলা হচ্ছে। এতদিন তো গণতন্ত্র সেনানিবাসে বন্দি ছিল। সারারাত কারফিউ থাকত। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পরই গণতান্ত্রিক অধিকার মানুষের হাতে ফিরে এসেছে। জনগণ আমাদের ভোট দিচ্ছে, আমরা জয়ী হচ্ছি। অত্যাচার-নির্যাতনের কথা শুনি। আমাদের কোনো নেতাকর্মী জিয়া, এরশাদ ও খালেদা জিয়ার আমলে নির্যাতনের হাত থেকে বাকি ছিল না। এখন তো সবাই কথা বলছে, জনসভা করছে, মিছিল করছে, বক্তৃতা করছে। আমরা রেডিও, টেলিভিশন উন্মুক্ত করে দিয়েছি বেসরকারিভাবে। ইচ্ছামতো টক শো করছি। আমরা তো কারও মুখ চেপে ধরছি না, গলা চিপেও ধরছি না। যে যা পারছে, বলতে পারে বলুক। আমরা রাষ্ট্র চালাচ্ছি জনগণের কল্যাণে।

আমলাদের নিয়ে বিভিন্ন মহলের সমালোচনার উত্তরে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকে অনেক দোষ দেয়। কিন্তু আমি দেখেছি আশ্রয়ণ প্রকল্পের সময়ে যারা একেবারে তরুণ (কর্মকর্তা) তাদের ভেতরে যে আন্তরিকতা, তাদের কাজ করার যে আগ্রহ-সেটা সত্যিই আমাকে আশার আলো দেখায়। সবাই যেন মনপ্রাণ ঢেলে কাজ করেছে। এই দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এ ধরনের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী তো দরকার। এ ধরনের অফিসার তো আমাদের দরকার।

ভূমিহীন-গৃহহীনদের জন্য গৃহনির্মাণ প্রকল্পে প্রতিটি ঘর স্বামী-স্ত্রীর যৌথ নামে দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটা যৌথ নামে করা হয়। এখানে যদি দ্বন্দ্ব দেখা দেয় তাহলে স্ত্রী পাবে, স্বামী নয়। এর পেছনেও একটা যুক্তি আছে। যার ঘরবাড়ি ছিল না, রাস্তায় পড়ে থাকত, তাকে আমি একটা ঘর দিলাম, নতুন ঘর পেয়ে যদি নতুন বউ নিয়ে আসে! তখন কী হবে? কাজেই নারীদের সুরক্ষা দেওয়া তো আমাদের দায়িত্ব। সেজন্যই আমি এ ব্যবস্থাটা করে দিয়েছি। আশ্রয়ণ প্রকল্প নারীর ক্ষমতায়ন ও সমতার একটা বিরাট দৃষ্টান্ত। কারণ বাড়ির মালিক দুজনে সমান।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার হারানোর কিছু নেই। পাওয়ারও কিছু নেই। আমার একটাই লক্ষ্য, বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের অন্ন, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেশকে উন্নত করে দেওয়া। সেটাই আমি করতে চাই। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলব। সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে আমরা কার্যক্রম অব্যাহত রাখব। এজন্য আমি সবার সহযোগিতা চাই। আমাদের নবযাত্রায় আরও সাফল্য আসুক। বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। বাংলাদেশের মানুষ আরও উন্নত সুন্দর জীবন পাবে।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়